গৌতম বুদ্ধের সাম্যনীতি

অষ্টম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বৌদ্ধ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা - | NCTB BOOK
1

প্রথম অধ্যায়

গৌতম বুদ্ধের সাম্যনীতি

গৌতম বুদ্ধকে সাম্যনীতির প্রবক্তা বলা হয়। সাম্যনীতি শব্দটি 'সাম্য' ও 'নীতি' শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। সাম্যনীতি বলতে বৈষম্যহীনতা, ন্যায় বিচার, মৌলিক অধিকার, পারস্পরিক মর্যাদাবোধ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা বোঝায়। সাম্যনীতি হচ্ছে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য নীতি যার মাধ্যমে সর্বপ্রকার বৈষম্য দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। বুদ্ধের ধর্মে এ নীতির বহুল প্রয়োগ দেখা যায়। বুদ্ধ তাঁর সঙ্ঘ পরিচালনায় সাম্যনীতিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ন্যায় বিচার ব্যতীত শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তিনি সাম্যনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে বিরাজমান বৈষম্যগুলো দূর করতে চেষ্টা করেছিলেন। এ অধ্যায়ে আমরা গৌতম বুদ্ধের সাম্যনীতি সম্পর্কে পড়ব । এ অধ্যায় শেষে আমরা

* গৌতম বুদ্ধের সাম্যনীতি বর্ণনা করতে পারব

* পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে বুদ্ধের সাম্যনীতির প্রভাব ব্যাখ্যা করতে পারব।

পাঠ : ১ বুদ্ধের সাম্যনীতি

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তু (বর্তমান নেপাল) নামক রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন । বুদ্ধত্ব লাভের পর থেকে তিনি বুদ্ধ নামে অভিহিত হন। তিনি সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর ধর্ম প্রচার করে আশি বছর বয়সে মহাপরিনির্বাণ লাভ করেন।

তাঁর সময়কালে সমাজজীবনে জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণ বৈষম্য চরম আকার ধারণ করেছিল। এ সামাজিক বৈষম্যগুলো দূর করার জন্য তিনি তাঁর ধর্মে সাম্যনীতিকে অগ্রাধিকার দেন। বৌদ্ধধর্ম মতে, সাম্যনীতি হচ্ছে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার মৌলিক ভিত্তি। সকল প্রকার দুঃখ, বৈষম্য, অন্যায়, অবিচার, ঘৃণা, সংঘাত প্রভৃতি বিদূরিত করার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে সাম্যনীতি। তাই সমাজে সাম্যনীতির প্রয়োগ অপরিহার্য। সাম্যনীতির কারণেই বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষের সীমারেখা অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বে প্রসারিত হয়েছে। এজন্য কোনো যুদ্ধ বা রক্তপাত ঘটেনি। বুদ্ধের সাম্যনীতি মানুষকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শিক্ষা দেয়। অপরের অভিমত ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সহিষ্ণু হতে শেখায়। জাতি, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল বৈষম্য ও বিভাজন বিদূরিত করে মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করেন। এ আদর্শকে বিকশিত করার উদ্দেশ্যে বুদ্ধ প্রথমেই ভিক্ষুসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠায় সাম্যনীতির প্রয়োগ করেন। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষকে প্রবেশাধিকার দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বুদ্ধ মহা-উপাসিকা বিশাখা নির্মিত শ্রাবস্তীর পূর্বারামে অবস্থান করার সময় বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

ভিক্ষুসঙ্ঘকে উপলক্ষ করে বলেন: 'ভিক্ষুগণ। গঙ্গা, যমুনা, অচিরাবতী, সরভূ ইত্যাদি নদী সমুদ্রে মিলিত হয়ে তাদের স্বতন্ত্র সত্ত্বা ও নাম হারিয়ে ফেলে, তেমনি ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য এবং শূদ্র আমার ধর্মে প্রবেশ করে জাতি, গোত্র ও নাম হারিয়ে ফেলে। এখানে সকল মানুষ সমান।

উপরের বাণী থেকে বোঝা যায়, বুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘ সকল পেশাজীবী মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এখানে উল্লেখ্য যে, বুদ্ধের সময়কালে সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রবল ছিল। তখন চণ্ডাল, মেখর, মুচি প্রভৃতি পেশায় নিয়োজিতদের নিম্নবর্ণ হিসেবে অভিহিত করা হতো। এরা অস্পৃশ্য ছিল এবং অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করত। তারা সামাজিক ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারত না। ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের অধিকার হতে বঞ্চিত ছিল। তারা ঘৃণিত ছিল। এবং অন্যরা তাদের স্পর্শ থেকে দূরে থাকত। কিন্তু বুদ্ধশিষ্য ভিক্ষু আনন্দ চণ্ডাল কন্যার হাত থেকে পানি পান করে সেই সংস্কারের মূলে কুঠারাঘাত করেন। এমন কি বুদ্ধ বৈশালীর বারবণিতা আম্রপালির নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে সমাজে তার মানবিক অবস্থানকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সুপ্তনিপাত গ্রন্থের বসল সূত্র পাঠে জানা যায় যে, মাতঙ্গ ছিল জন্মসূত্রে এক চণ্ডাল পুত্র। পরবর্তীতে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে সকল প্রকার লোভ দ্বেষ-মোহ, তৃষ্ণা ও কামরাগ পরিত্যাগ করে শীল, সমাধি। প্রজ্ঞা অনুশীলনপূর্বক দুর্লভ শ্রেষ্ঠ কীর্তি অর্হত্ব ফল প্রাপ্ত হন। তখন তাঁর সেবা ও পরিচর্যা করার জন্য অনেক ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পুত্র নিয়োজিত হয়েছিলেন। এ সূত্রে আরো উল্লেখ আছে যে, ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেও অনেকে পাপকার্যে লিপ্ত থাকত। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, আধ্যাত্মিকতায় কিংবা অর্হত্ব বা নির্বাণ লাভের জন্য জাতি, গোত্র, বর্ণ যেমন প্রতিবন্ধক নয় তেমনি সহায়কও নয়। কুশল- অকুশল কর্মই মানুষের পরিচয় নির্ধারণ করে। ত্রিপিটকের সুত্তনিপাত গ্রন্থের 'বসল সূত্রে বুদ্ধ বলেছেন:

ন জচ্চা বসলো হোতি, ন জচ্চা হোতি ব্ৰাহ্মণো

কম্মুনা বসলো হোতি, কমুনা হোতি ব্ৰাহ্মণো ।। অর্থাৎ জন্মের দ্বারা কেউ বসল বা চণ্ডাল হন না, তেমনি জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ হন না। কর্মের দ্বারা চন্ডাল হয়, কর্মের দ্বারাই ব্রাহ্মণ হন ।

ধর্মপদ গ্রন্থের ব্রাহ্মণ বর্গেও অনুরূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন :

ন জটাহি ন গোত্তেহি ন জচ্চা হোতি ব্ৰাহ্মণো

যমূহি সচঞ্চ ধম্মো চ সো সুচি সো চ ব্রাহ্মণো ।।

অর্থাৎ জটার দ্বারা, গোত্রের দ্বারা এবং জাতি দ্বারা কেহ ব্রাহ্মণ হয় না। বরং যিনি সম্পূর্ম পরিজ্ঞাত হয়েছেন তিনিই পবিত্র এবং তিনিই প্রকৃত ব্রাহ্মণ ।.

বাসেট্ঠ সূত্রে বুদ্ধ এ প্রসঙ্গে আরো বলেছেন, 'জাতি হিসেবে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই । ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের পদচিহ্ন একই রূপ। হাতি, ঘোড়া, বাঘ এরূপ চতুষ্পদ প্রাণীদের মতো মানুষে মানুষে দৈহিক গঠনে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। প্রাণীদের মধ্যে স্ত্রী, পুরুষ, বর্ণ, শারীরিক গঠন, লোম, চঞ্চু প্রভৃতিতে পার্থক্য আছে। মানুষে মানুষে তেমন পার্থক্য দেখা যায় না। মূলত, জীবনের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, বুদ্ধিমত্তা, বিচারশক্তি, আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে মানুষে মানুষে অথবা জাতিতে জাতিতে তেমন কোনো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না।

বুদ্ধের সময়কালে কন্যা সন্তানের জন্ম কাম্য ছিল না। সংযুক্ত নিকায়ের কোসল সংযুক্ত পাঠে জানা যায় যে, রাজমহিষী মল্লিকাদেবী কন্যা সন্তান প্রসব করেছেন শুনে কোশলরাজ প্রসেনজিত খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েন। বুদ্ধ জানতে পেরে রাজসমীপে উপস্থিত হয়ে রাজা প্রসেনজিতকে বললেন, 'কন্যা সন্তানের জন্ম হেতু কারও দুঃখ পাওয়া উচিত না, কন্যা যদি তীক্ষ্ণ বুদ্ধি সম্পন্ন, ধর্মপ্রাণ, সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল হয়, তাহলে কন্যা সন্তান পুত্রাপেক্ষা শ্রেয়সী হবার যোগ্যতা রাখে। এমনকি এই কন্যা সন্তান রত্নগর্ভা ও হতে পারে। তার গর্ভজাত সন্তান ভবিষ্যতে মহৎ কার্য সম্পন্ন করতে পারে এবং সুবিশাল রাজ্যের অধিশ্বর হতে পারে। বুদ্ধের বাণী শুনে রাজা প্রসেজিত কন্যা সন্তানের জন্মকে শুভ বলে মেনে নেন ।

বুদ্ধের সময়কালে এরূপ অনেক ধরনের বৈষম্য প্রচলিত ছিল। বুদ্ধ সাম্যনীতির মাধ্যমে তথাকথিত সামাজিক বৈষম্যগুলো দূরীভূত করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। অনাদিকাল থেকেই মানুষ সমাজে সাম্যনীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে আসছে। বুদ্ধই প্রথম সমাজে সাম্যনীতি প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন।

অনুশীলনমূলক কাজ

বুদ্ধের সাম্যনীতির শিক্ষা কী? কীসের দ্বারা মানুষের পরিচয় নির্ধারিত হয় ?

পাঠ : ২

বুদ্ধের সাম্যনীতির প্রয়োগ

বুদ্ধের সমকালীন সমাজে নিম্নশ্রেণির মানুষের তেমন কোনো সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার ছিল না। বুদ্ধ অবহেলিত নিম্নশ্রেণির মানুষকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ভিক্ষুসঙ্ঘে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন। সে সময়ে সমাজে নিম্নশ্রেণির মানুষের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, ধর্ম ও অন্যান্য বিদ্যা শিক্ষায় বিধি-নিষেধ ছিল। বৃদ্ধ সঙ্গে প্রবেশের সুযোগ করে দিয়ে ধর্ম ও বিদ্যা চর্চায় তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। নিচে প্রাসঙ্গিক একটি কাহিনি বর্ণনা করা হলো বুদ্ধের সময়কালে রাজগৃহের একপ্রান্তে এক অস্পৃশ্য দরিদ্র ধাঙর (মেথর) পরিবার বাস করত। সেই পরিবারে সুনীত নামে এক ছেলে ছিল। বড় হয়ে সেও জাতের পেশা গ্রহণ করে। রাজপথ ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করা, ময়লা-আবর্জনা নগরের বাইরে নিক্ষেপ করা প্রভৃতি ছিল তার নিত্য কাজ । এ কাজে কটুক্তি ও তিরস্কার ছিল তার নিত্য পাওনা। অস্পৃশ্য বলে তাচ্ছিল্য, অবহেলা ও অনাদরে তার দিন কাটত। সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে সে গ্লানিময় জীবনের কথা ভাৰত।

একদিন সে ঝুঁড়িভর্তি আবর্জনা নিয়ে পথ চলছিল। তখন সে পথে সশিষ্য বুদ্ধ নগরে আসছিলেন। বুদ্ধ কাছাকাছি এলে সে আবর্জনার ঝুড়ি নামিয়ে সকলের ছোঁয়া এড়িয়ে কুণ্ঠিতভাবে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ভাবছিল, আহা ! আমি যদি ভগবান বুদ্ধের পদতলে ঠাঁই পেতাম । বুদ্ধ তার মনোবাসনা জানতে পেরে তার সামনে এসে মৈত্রীময় দৃষ্টিতে তাকালেন । বুদ্ধ তার মাথায় হাত রেখে বললেন, এসো সুনীত। আমার সঙ্গে বিহারে চলো। সুনীত বিষয়ে হতবাক হলো। সে ভাবল, 'আমি রাস্তার ঝাড়ুদার, সবার অবজ্ঞার পাত্র। কিন্তু সর্বজন পূজ্য ভগবান বুদ্ধ আমাকে স্পর্শ করে স্নেহজড়িত কণ্ঠে আহ্বান করলেন। সে আবেগ-বিহ্বল হয়ে বুদ্ধের চরণে লুটিয়ে পড়ল । অতঃপর বুদ্ধ তাকে বিহারে নিয়ে দীক্ষা দেন এবং ভিক্ষুসংঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে নেন । সংজ্যে প্রবেশ করে অল্পকালের মধ্যে সুনীত সর্ব আসক্তি ক্ষয় করে অর্হত্ব লাভ করেন। বৌদ্ধ সাহিত্যে এরূপ আরো অনেক কাহিনী পাওয়া যায়, যা থেকে জানা যায় যে, সুনীতের মতো অনেকে বুদ্ধের সঙ্ঘে প্রবেশ করে মেধার প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হন। যেমন: উপালী ছিলেন নাপিতপুত্র। তিনি সঙ্ঘে প্রবেশ করে বুদ্ধের অন্যতম শিষ্যে পরিণত হন এবং বিনয়ে পারদর্শীতা অর্জন করে "বিনয়ধর' উপাধিতে ভূষিত হন। তিনি বিনয় সম্পর্কিত বুদ্ধের সকল দেশনা স্মৃতিতে ধারণ করে রেখেছিলেন। বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তিনি প্রথম মহা-সঙ্গীতিতে বুদ্ধ দেশিত বিনয়সমূহ আবৃত্তি করেন, যা বিনয় পিটকে সংকলিত আছে। অনুরূপ কুল্ল স্থবির ছিলেন কৃষক। 'যশ স্থবির' ছিলেন মালীর পুত্র। 'হিরণ্যক স্থবির' ছিলেন এক চোরের পুত্র। ছন্ন' বা 'ছন্দক' ছিলেন দাসীর পুত্র। গণিকা আম্রপালির পুত্র ছিলেন 'বিমল স্থবির'। এ ধরনের আরো অনেক সাধারণ ঘরের মানুষ বুদ্ধের শিষ্য হয়ে কর্ম গুণে যশ, খ্যাতি এবং গৌরব লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

এভাবে বুদ্ধ সকল পেশার লোককে সঙ্ঘে প্রবেশ ও ধর্ম চর্চার অধিকার দিয়ে মনুষ্যত্বের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন। জন্ম ও জীবিকার কারণে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার প্রচলিত প্রথা বুদ্ধ মিথ্যা প্রতিপন্ন করেন।

জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণবৈষম্য বিলোপ সাধনের অনেক উদাহরণ বুদ্ধের জীবনচরিতে পাওয়া যায় । বুদ্ধের ধর্মে সর্বস্তরের মানুষ স্থান লাভ করেছে।গৌতম বুদ্ধের সাম্যনীতি

বিভিন্ন বংশ হতে আগত ভিক্ষুগণ একত্রে ধর্ম প্রবণ করছেন বুদ্ধের সময়কালে নারী সঙ্ঘভুক্ত হয়ে বা স্বাধীনভাবে ধর্ম ও বিদ্যা চর্চা করতে পারতেন না। বুদ্ধ ভিক্ষুণী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করে ধর্ম ও শাস্ত্র অধ্যয়নে নারীদের সুযোগ করে দেন। ত্রিপিটকে, বিশেষত খেরীপাখা গ্রন্থে অনেক নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা ধর্ম ও বিদ্যা চর্চায় পারদর্শীতা ও সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। থেরীগাথা পাঠে জানা যায় যে, সুমঙ্গলের মা সংসারের অভাব-অনটন এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ধ্যান সাধনা করেন। এতে তিনি তার মনের রিপুসমূহ সংযত করে অর্থত্ব ফল লাভ করেন বৈশালী নগরীর গণিকার কন্যা বিমলা একদিন মৌদগল্যায়ন স্থবিরের উপদেশে ভিক্ষুণী হন। পরে তিনি কঠোর সাধনার মাধ্যমে অর্থ ফল লাভ করেন। এভাবে ব্যাথের মেয়ে চাঁপা, শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিকের দাসী পূর্ণিকা, স্বর্ণকারের কন্যা গুণ্ডা, দরিদ্র পরিবারের মেয়ে কৃষ্ণা গৌতমী বুদ্ধের ধর্মে দীক্ষিত হয়ে গভীর সাধনার মধ্য দিয়ে অত্ব ফল লাভ করতে সক্ষম হন। তাছাড়া তাঁর ধর্মে রাজা, মহারাজা, রানি, রাজকন্যা, প্রেতী কন্যাও স্থান পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে শাক্যরাজ অন্ধোপনের মহিষী মহাপ্রজাপতি গৌতমী, মহারাজ বিভিসারের রানি ক্ষেমা, কোশলের মহারাজার বোন সুমনা অন্যতম। ভিক্ষুণীদের মধ্যে অনেকেই ধর্ম ও দর্শন চর্চায় সুপণ্ডিত ছিলেন। ধর্ম দেশনার, বিনয়কর্ম সম্পাদনে এবং শাস্ত্র অধ্যয়নে তাঁরা ভিক্ষুদের সমকক্ষ হতে পেরেছিলেন। ? ভিক্ষুণী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার সময় বুদ্ধ আনন্দকে বলেছিলেন: 'হে আনন্দ। পুরুষের ন্যায় নারীরাও বৌদ্ধধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

শ্রামণ্যফলের অধিকারী হতে পারে।' তিনি আরো বলেন, 'নারীরা উচ্চতর শ্রামণ্যফল লাভের যোগ্য এবং ক্ষেমা, উৎপলবর্ণা, ধর্মদিনা, ভদ্দকপিলানীর ন্যায় ভিক্ষুণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে আমার প্রবর্তিত শাসনের মঙ্গল ব্যতীত অমঙ্গল হবে না। বুদ্ধের এ বাণীতে ধর্ম ও বিদ্যা চর্চায় নারীরা পুরুষের সমকক্ষ তা স্বীকৃত হয়েছে ।

অনুশীলনমূলক কাজ

উপালীর উপাধি কী ছিল? তিনি স্মৃতিতে কী ধারণ করে রাখতেন?

কতিপয় বুদ্ধ শিষ্যের নাম লেখ যাঁরা বিভিন্ন পেশা থেকে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে খ্যাতিমান হয়েছিলেন। ভিক্ষুণী সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার সময় বুদ্ধ আনন্দকে কী বলেছিলেন?

পাঠ : : ৩

বৌদ্ধ সাম্যনীতির সামাজিক প্রভাব

সমাজজীবনে বুদ্ধের সাম্যনীতির অশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বুদ্ধের সময়কালে তথাকথিত নিম্নবর্ণ হিসেবে সমাজে যারা অবহেলিত, নিগৃহীত, নিষ্পেষিত ও ঘূর্ণিত ছিল তারা বুদ্ধের সাম্যনীতির প্রভাবে আত্ম মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা লাভ করেছিল। বুদ্ধের সাম্যনীতি প্রমাণ করেছে যে, পেশাগত দক্ষতা ও মেধার মাধ্যমে সমাজে যে কেউ প্রতিষ্ঠা ও সুখ্যাতি লাভ করতে পারে। এই সত্যটি উপলব্ধি করে সেদিন জন্মগত কারণে অবহেলিত মানুষগুলো কমের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। বুদ্ধের সাম্যনীতির ফলে ধর্ম ও বিদ্যা চর্চায় নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং নারীদের মুক্ত চিন্তার দ্বার উন্মোচিত হয় ।

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটেও বুদ্ধের সাম্যনীতি গুৰুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বুদ্ধের

সাম্যনীতি অনুশীলনের মাধ্যমে ১। জাতিগত বিদ্বেষ দূর করে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

২। সকলের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা যেতে পারে।

৩। পরধর্ম ও পরমতের প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শনের মনোভাব সৃষ্টি করা যেতে পারে ।

৪। পেশা ও শ্রমের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে ।

৫। নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করে সমান সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে ।

৬। ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

৭। পরিবার থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিরাজমান সকল বৈষম্য দূর করা যেতে পারে।

Content added || updated By
Promotion